গর্ভাবস্থায় উপযুক্ত খাদ্য তালিকা অনুযায়ী সঠিক পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। কারণ গর্ভবতী মায়ের উচিত শিশু যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় তা নিশ্চিত করা। এজন্য মায়ের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও কিছু খাবার আছে যেগুলো গর্ভাবস্থায় খাওয়া নিরাপদ নয়।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
১। দিনে ৫ বার ফল ও ৭ বার সবজি খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ফলের চেয়ে শাকসবজি বেশি খান। ফলের জুস ও স্মুদিও পান করতে পারেন। তবে এগুলোতে যুক্ত অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় উপাদান সুগার ব্লাড সুগার লেভেল বৃদ্ধি করতে পারে এবং দাঁতেরও ক্ষতি করতে পারে। তাই এগুলো সীমিত পরিমাণে চিনি বা মিষ্টিকারক উপাদান যুক্ত করবেন। ফলের রস না খেয়ে পুরো ফল টাকেই ব্ল্যান্ড করে নিবেন, এতে ভিটামিন মিনারেলস এর সাথে সাথে আঁশ পাবেন,যা আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। তাজা ফল ও সবজি খাওয়াই বেশি স্বাস্থ্যকর।
২। স্টার্চ জাতীয় খাবার যেমন আলু, লাল চালের ভাত, রুটি, পাস্তা ইত্যাদি স্টার্চ জাতীয় খাবার আপনার প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় রাখুন। শর্করা জাতীয় খাবার শরীরে এনার্জি প্রদানে সাহায্য করে। তবে আপনি যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত থাকেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই এখন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ থেকে জেনে নিবেন,আপনার শর্করা জাতীয় খাবার কতটুকু খেতে হবে।
৩। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন চর্বিহীন মাংস, মুরগী (চামড়া ও পাখনা বাদে), মাছ, ডিম, ডাল (মটরশুঁটি, মসূর ডাল) ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। আমিষ জাতীয় খাবার গর্ভের শিশুর শরীরের নতুন টিস্যু গঠনের জন্য সাহায্য করে। সপ্তাহে ২ দিন বা তারচেয়েও বেশি মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন। সারডিন, স্যামন এর মত তৈলাক্ত মাছ বা সামুদ্রিক মাছ সপ্তাহে ১ দিন খেতে পারেন। বেশি সামুদ্রিক মাছ খেলেও ক্ষতি হয়,কারন এতে মার্কারি থাকে যা গর্ভস্থ বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারন হয়।
৪। দুগ্ধজাত খাবার যেমন দুধ, পনির, দই ইত্যাদি খাবারগুলো ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস। এগুলোতে চিনি ও ফ্যাটের পরিমাণ যেন কম থাকে সেটি খেয়াল করতে হবে। ফ্যাট জাতীয় খাবার গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে।
অনেক মা এর শরীরেই আয়োডিনের ঘাটতি থাকে। আয়োডিন এমন একটি খনিজ উপাদান যা শিশুর মস্তিষ্কের গঠনের জন্য অপরিহার্য। দুগ্ধজাত খাবার ও সামুদ্রিক খাবার আয়োডিনের চমৎকার উৎস।
গর্ভাবস্থায় যে খাবারগুলো খাওয়া উচিৎ নয়
১। ক্যাফেইন: কফি ক্লান্তি দূর করার জন্য কার্যকর হলেও গর্ভাবস্থায় এর পরিমাণ কম করতে হবে। চা, কফি ইত্যাদিতে ক্যাফেইন থাকে। দৈনিক ২০০ গ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করা ঠিক নয়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম গ্রহণ করে। মিসক্যারেজের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।
২। অর্ধসিদ্ধ মাংসে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। প্যাকেটজাত মাংস যেমন- সসেজ খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। মাংস ভালো ভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
৩। অপাস্তুরিত দুধ বা কাঁচা দুধে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই ভালো করে না ফুটিয়ে দুধ পান করা যাবেনা। অপাস্তুরিত দুধ দিয়ে তৈরি খাবার যেমন- নরম পনির খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। কলিজা ও কলিজার তৈরি খাবার: লিভারে রেটিনল থাকে যা একটি প্রাণীজ ভিটামিন এ। এর অতিরিক্ততা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৫। ডিম পুষ্টিকর একটি খাবার। অনেকেরই আবার কাঁচা ডিম খাওয়ার অভ্যাস থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় কাঁচা ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ কাঁচা ডিমে সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই ডিম ভালোভাবে সিদ্ধ না করে খেতে হবে
৬। সামুদ্রিক মাছ: সামুদ্রিক মাছ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু অধিক পরিমাণে খেলে গর্ভের শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কারণ সামুদ্রিক মাছে পারদ জাতীয় পদার্থ থাকে।
৭। কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে: গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে খাওয়া বিপদজনক। এতে গর্ভপাতের মত ঘটনা ঘটতে পারে।
Harvard School of Public Health
প্রেগনেন্ট নারীদের জন্য হার্ভার্ড হেলথি ইটিং প্লেট নামে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। যেখানে নিমোক্ত খাবার এর ব্যাপারে বলা হয়েছে।
- আস্ত শস্যদানার খাবার খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে
- স্বাস্থ্যকর ভেজিটেবল ওয়েল গ্রহণ করতে হবে ।
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার সীমিত পরিমাণে অর্থাৎ দিনে ১/২ বার খেতে হবে।
- লাল মাংস সীমিত পরিমাণে এবং প্রসেসড মাংশ এড়িয়ে চলতে হবে।
- রিফাইন্ড শস্য দিয়ে তৈরি সাদা পাউরুটি ও সাদা চালের ভাত এড়িয়ে চলতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন
- চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলবেন।
- নিয়মিত ও উপযোগী ব্যায়াম করতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি
গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কিছু নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান উপস্থিত আছে কি না সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এর পাশাপাশি গর্ভকালীন সময়ের অতিরিক্ত পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য আপনাকে কিছু ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের ট্যাবলেট বা বড়িও সেবন করতে হবে। যা আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
ফলিক এসিড
ফলিক এসিডের অপর নাম ভিটামিন বি৯। এই পুষ্টি উপাদানটি মা ও শিশু উভয়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলিক এসিড গর্ভের শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ গঠনে সাহায্য করে। এর অভাবে স্নায়ুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ—নিউরাল টিউবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: স্পাইনা বিফিডা রোগ।
সন্তান নেওয়ার চেষ্টা শুরু করার সময় থেকেই এই পরিমাণে ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও তিন মাস পর্যন্ত ফলিক এসিড সেবন করা চালিয়ে যেতে হবে। তবে গর্ভধারণের আগে থেকেই ফলিক এসিড না গ্রহণ করে থাকলে, আপনি যে গর্ভবতী তা জানার পর পরই যত দ্রুত সম্ভব ফলিক এসিড সেবন করা শুরু করতে হবে।
ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?
প্রাকৃতিক খাবারে পাওয়া ফলিক এসিডকে ‘ফোলেট’ বলে। প্রতিদিন ০.৪০ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনি প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার রাখবেন। এমন কিছু খাবার হলো—
- বিভিন্ন শাক। যেমন: পালং শাক, পুঁই শাক, পাট শাক, কচু শাক, মেথি শাক, সজনে পাতা, লাল শাক, নটে শাক, সবুজ ডাঁটা শাক, মুলা শাক ও লাউ শাক
- বিভিন্ন সবজি। যেমন: বরবটি, মটরশুঁটি, ঢেঁড়স, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ব্রকলি
- ছোলার ডাল, মাসকলাই ডাল ও মুগ ডাল
- বিভিন্ন ফল। যেমন: কমলা
- চিনাবাদাম
আয়রন
আয়রন গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে। সেই সাথে আপনার গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশে সাহায্য করে। এ ছাড়াও এটি সঠিক সময়ের পূর্বেই শিশু জন্মদান এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশু জন্মদানের মতো জটিলতার সম্ভাবনা কমায়।
গর্ভাবস্থার শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী মহিলাদের এই পরিমাণে আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এসব ট্যাবলেটে আয়রনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ফলিক এসিড যোগ করা থাকে।
উল্লেখ্য, তীব্র রক্তশূন্যতার মতো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে তুলনামূলকভাবে উচ্চ ডোজে আয়রন সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
আয়রনসমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনাকে নিয়মিত আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হলো—
- রেড মিট। যেমন: গরু ও খাসির মাংস
- বিভিন্ন মাছ। যেমন: চাপিলা, ট্যাংরা, কাচকি, মলা, টাটকিনি, শিং, ফেসা ও চেলা
- ডিম
- দুধ ও পনির
- বিভিন্ন ধরনের ডাল। যেমন: মটর, ছোলা, মাসকলাই, মুগ ও মসুর
- চিনাবাদাম ও পেস্তাবাদাম
- শাক। যেমন: পাট শাক, লাল শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, নটে শাক, সবুজ কচু শাক, চুকাই শাক, বরবটি পাতা, মালঞ্চ শাক, বকফুল শাক, মূলা শাক, লাউ শাক, পালং শাক ও পুঁই শাক
- সবজি। যেমন: আলু, ব্রকলি, মটরশুঁটি ও মাশরুম
- শুকনো ফল। যেমন: খেজুর, নারিকেল (শুকনা) ও আখরোট
- বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: বাজরা, যব, কাউন, ভুট্টা, চিড়া, গম ও লাল চাল
- বিভিন্ন বীজ। যেমন: তিল, সরিষা, তিসি, সয়াবিন, মিষ্টিকুমড়া বীজ, সূর্যমুখী বীজ, পদ্ম (শুকনা) ও চিলগোজা
মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়ে গর্ভাবস্থায় আপনার ও গর্ভের শিশুর আয়রনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই আয়রন সমৃদ্ধ একটি সুষম খাবার তালিকা মেনে চলার পাশাপাশি নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড সেবন করা জরুরি।
ক্যালসিয়াম
ক্যালসিয়াম আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া নামক গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপজনিত মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। সেই সাথে গর্ভের শিশুর হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম একটি অত্যাবশ্যক উপাদান৷ ক্যালসিয়ামের অভাবে আপনার ও গর্ভের শিশুর হাড় ভঙ্গুর হতে পারে এবং শারীরিক গঠনে নানান জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
সেবনের নিয়ম কী?
গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের পর থেকে প্রতিদিন ২ বেলা করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করবেন। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরাপেটে খাওয়া ভালো।
কোথায় পাবেন?
- বাংলাদেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। তাই গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আপনি সহজেই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করতে পারেন।
- ফার্মেসি থেকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিনে খেতে পারেন। তবে কেনার আগে ডাক্তারের কাছ থেকে গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক ডোজটা জেনে নিবেন। সেই অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিনবেন।
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?
ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের পাশাপাশি আপনি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিছু ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার হলো—
- দুধ ও দুধের তৈরি খাবার। যেমন: টক দই ও পনির
- বিভিন্ন মাছ। যেমন: টাকি, রুই, কাতলা, শোল, শিং, টাটকিনি, পারশে, পুঁটি, চান্দা, কই, কাচকি, মলা, চেলা, মৃগেল, মেনি, চাপিলা, খলিশা, বাচা, ফলি, বাটা, ট্যাংরা, ভেটকি, রূপচাঁদা ও চিংড়ি। উল্লেখ্য, কাঁটাসহ
- ছোটো মাছ খেলে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়
- বিভিন্ন ডাল। যেমন: ছোলা ও মাসকলাই
- সয়াবিন ও টফু
- বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: যব, কাউন, চিঁড়া ও গম
- বিভিন্ন শাক। যেমন: লাল শাক, পুঁই শাক, নটে শাক, বকফুল শাক, মালঞ্চ শাক, সবুজ ডাটা শাক, লাউ শাক, কচু শাক, সজনে পাতা ও মেথি শাক
- বিভিন্ন বীজ। যেমন: তিল, তিসি ও সরিষা
তবে শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়েই গর্ভকালীন সময়ে ক্যালসিয়ামের বাড়তি চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় আলাদা করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। তা ছাড়া গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মাল্টিভিটামিন সেবন করলে সেটায় সঠিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে কি না তা লক্ষ করতে হবে। প্রয়োজনে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।
ভিটামিন ডি
ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে এটি আমাদের শরীরের পেশি, হাড় ও দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আমাদের ত্বক সূর্যের আলোতে থাকা অতিবেগুনী রশ্মি ব্যবহার করে ভিটামিন ডি তৈরি করে। কিন্তু জামাকাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা থাকার কারণে অনেকসময় শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না। এমন ক্ষেত্রে খাবার ও প্রয়োজনে আলাদাভাবে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করে শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এর যোগান দিতে হয়।
আপনার দেহে ভিটামিন ডি এর অভাব থাকলে আপনার গর্ভের শিশুর ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। এতে জন্মের পরে শিশুর দেহে ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন ডি সেবনের নিয়ম কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত ভিটামিন ডি ট্যাবলেট খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে ভিটামিন ডি-এর অভাবজনিত সমস্যায় ভুগলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে প্রতিদিন ৫ মাইক্রোগ্রাম বা ২০০ ইউআই পরিমাণ ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন। তবে গর্ভকালীন সময়ে আপনাকে অবশ্যই প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে।
ভিটামিন ডি-এর প্রাকৃতিক উৎস কী?
সূর্যের আলো
প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি পাওয়ার প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। সূর্যের আলো আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরি উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করে।
ঠিক কতটুকু সময় রোদে থাকলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য এখনও জানা যায়নি। আমাদের ত্বকের রং, রোদের তীব্রতা, দিনের বিভিন্ন সময় ও শীত-বর্ষা-গ্রীষ্মকালসহ আরও অন্যান্য বিষয়ের ওপর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়ার হার নির্ভর করে।
তবে বেশিক্ষণ কড়া রোদে থাকলে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া কিংবা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোদে যাওয়ার আগে ত্বকে অন্তত এসপিএফ ১৫ শক্তিমাত্রার সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিবেন।
বিভিন্ন ধরনের খাবার
সূর্যের আলো ছাড়াও কিছু খাবারে কিছু পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ কিছু খাবার হলো—
- ডিম
- বিভিন্ন ধরনের মাংস
- বিভিন্ন মাছ। যেমন: কাতলা, মৃগেল, রুই ও তেলাপিয়া
- ফর্টিফাইড ভোজ্য তেল। বাংলাদেশ সরকার ভোজ্য তেলে ভিটামিন ডি ও ভিটামিন এ মেশানোর মাধ্যমে এসব ভিটামিনের অভাব প্রতিরোধে কাজ করছে
উল্লেখ্য, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই আপনার গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত কিছুক্ষণ রোদ পোহানো উচিত। এতে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
আপনি সবসময় পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে সূর্যের আলোতে গেলে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে বাসা থেকে বের না হলে আপনার ত্বকে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারবে না এবং ভিটামিন ডি-ও তৈরি হতে পারবে না। ফলে আপনার ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন।
ভিটামিন এ
গর্ভের শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ (যেমন: হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্র) গঠনে এবং চোখের সুস্থতা রক্ষায় ভিটামিন এ সাহায্য করে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ভিটামিন এ-এর অভাব হলে গর্ভের শিশুর নানান ধরনের জটিলতা দেখা যায়। যেমন: দৃষ্টিশক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া। এ ছাড়াও গর্ভবতী নারীর সুস্থতা বজায় রাখতেও ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গর্ভকালীন সময়ে সাধারণত আলাদা করে ভিটামিন এ ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন নেই। খাবার থেকেই এই সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।
অনেকেই গর্ভধারণের আগে থেকে কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করে থাকতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী আপনার ভিটামিন ট্যাবলেটে ভিটামিন এ-এর দৈনিক মাত্রা সর্বোচ্চ ১০০০০ IU এর মধ্যে সীমিত থাকে। কেননা অতিরিক্ত ভিটামিন এ গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?
গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণের জন্য আপনি যেসব খাবার খেতে পারেন সেগুলো হলো—
- দুধ ও দুধের তৈরি খাবার। যেমন: দই ও পনির
- লাল, হলুদ ও সবুজ শাকসবজি। যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, লাল শাক, কচু শাক ও পালং শাক
- রঙিন ফলমূল। যেমন: আম, পাকা পেঁপে, তাল, ডেউয়া ও বাঙ্গি
- ডিম
- তৈলাক্ত মাছ
উল্লেখ্য, কলিজা ও মাছের তেল ভিটামিন এ-এর খুবই ভালো উৎস। কিন্তু এগুলোতে অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে, যা সাধারণ অবস্থায় খাওয়া গেলেও গর্ভাবস্থায় শিশুর ক্ষতি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ভিটামিন এ সেবনে গর্ভের শিশুর চোখ, মাথার খুলি, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের মতো অঙ্গে জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন সি
ভিটামিন সি আমাদের শরীরের ত্বক, হাড় ও রক্তনালীকে সুস্থ রাখে। পাশাপাশি শরীরের যেকোনো ধরনের আঘাত ও ক্ষতস্থানের ঘা শুকাতে সাহায্য করে৷
সেবনের নিয়ম কী?
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন সি এর দৈনিক চাহিদা পূরণের জন্য সাধারণত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলেই হয়। এজন্য আলাদাভাবে ট্যাবলেট খাওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না। উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটে ৭০ মিলিগ্রাম করে ভিটামিন সি যোগ করা থাকে। আপনি চাইলে নিয়মিত এভাবে ভিটামিন সি খেতে পারেন।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?
- বিভিন্ন ফল। বিশেষত টক ফল। যেমন: আমলকী, আমড়া, জাম, জলপাই, লেবু, জাম্বুরা, পেয়ারা, কমলা ও মাল্টা
- কাঁচা মরিচ ও ধনে পাতা
- লাল ও সবুজ ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, কাঁকরোল ও আলু