ছোলা ডাল জাতীয় পুষ্টিকর একটি শস্যদানা। যা সেদ্ধ বা তরকারি করে রান্না করার পাশাপাশি পানিতে ভিজিয়ে রেখে কাঁচাও খাওয়া যায়। ছোলাতে পরিমিত পরিমাণে ক্যালোরি ও বেশ কিছু ভিটামিনের পাশাপাশি প্রোটিন, আমিষ, ট্রিপট্যোফান, কপার, ফসফরাস, আয়রণ ও প্রচুর পরিমাণে খাদ্য আঁশ তথা ফাইবার রয়েছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
গবেষণা বলছে, রাতে কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে রেখে সকালে খোসা ছাড়িয়ে কাঁচা আদার সঙ্গে খেলে শরীরে আমিষ ও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। ফলে দেহকে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জানা যায়, এক কাপ (১৬৪ গ্রাম) রান্না করা ছোলায় ক্যালোরি ২৬৯, প্রোটিন: ১৪.৫ গ্রাম, চর্বি ৪ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৪৫ গ্রাম, ফাইবার ১২.৫ গ্রাম এবং দৈনিক মূল্যের ম্যাঙ্গানিজ ৭৪%, ফোলেট (ভিটামিন বি৯) ৭১%, তামা ৬৪%, আয়রন ২৬%, দস্তা ২৩%, ফসফরাস ২২%, ম্যাগনেসিয়াম ১৯% থায়ামিন ১৬%, ভিটামিন বি৬ ১৩%, সেলেনিয়াম ১১% ও পটাসিয়াম ১০% থাকে।
কাঁচা ছোলা খাওয়ার উপকারিতা
ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং ফাইবারের সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে ছোলার বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা দেখা যায়। বিশেষ করে ওজন কমাতে সহায়তা ও হজম প্রক্রিয়ার উন্নতিকরণসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে ছোলা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এ পর্যায়ে ছোলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা তুলে ধরা হলো-
ওজন নিয়ন্ত্রণে
ছোলা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। কারণ ছোলার মধ্যে থাকা প্রোটিন এবং ফাইবার ক্ষুধা কমাতে সহায়তা করে। যা খাবারে ক্যালোরির পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে ওজন কমে যায়। স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত ছোলা খাওয়া ব্যক্তিদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) হওয়ার সম্ভাবনা ৫৩% কম ছিল। এমনকি তাদের ওজন দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।
হজমে সহায়ক
ছোলাতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। কেননা ছোলাতে থাকা ফাইবার বেশিরভাগই দ্রবণীয়। যা পানির সাথে মিশে পরিপাকতন্ত্রে জেলের মতো পদার্থ তৈরি করে। এসব দ্রবণীয় ফাইবার অন্ত্রে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার অতিরিক্ত বৃদ্ধি রোধ করে। ফলে হজম অবস্থার ঝুঁকি হ্রাস করে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। একটি পর্যালোচনা অনুসারে, ছোলা মলত্যাগের ফ্রিকোয়েন্সি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সামঞ্জস্যতা রক্ষার মাধ্যমে হজম শক্তিকে উন্নতি করে।
উদ্ভিদ প্রোটিন সমৃদ্ধ
ছোলা উদ্ভিদ-ভিত্তিক প্রোটিনের একটি বড় উৎস। মাংস বা পশুজাত দ্রব্য না খাওয়া লোকেদের জন্য ছোলা দিয়ে চমৎকার একটি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি হয়। কারণ একটি ১-কাপ (১৬৪ গ্রাম) ছোলা পরিবেশন প্রায় ১৪.৫ গ্রাম প্রোটিন সরবরাহ করে। যা কালো মটরশুটি এবং মসুর ডালের মতো অনুরূপ খাবারের প্রোটিন সামগ্রীর সাথে তুলনীয়। ছোলার মধ্যে থাকা প্রোটিন পূর্ণতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে। এখানে প্রোটিন ওজন ব্যবস্থাপনা, হাড়ের স্বাস্থ্য গঠন ও পেশী শক্তিতে ভূমিকা রাখে।
ব্যথা উপশমে
মেরুদণ্ডের ব্যথা উপশমে ছোলা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। কেননা ছোলাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা ভিটামিন ‘বি’ মেরুদণ্ডের ব্যথা ও স্নায়ুর দুর্বলতা রোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অ্যাজমা রোগে
অ্যাজমা বা এলার্জি জনিত সমস্যায় ছোলা উপকারী। কারণ ছোলাতে থাকা ফলিক অ্যাসিড রক্তের অ্যালার্জির পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি অ্যাজমার প্রকোপও কমিয়ে দেয়। তাই এসব সমস্যায় নিয়মিত ছোলা খেলে উপকার মেলে।
যৌনশক্তি বাড়াতে
যৌনশক্তি বাড়াতে ছোলার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমিষ মানবদেহকে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান করতে সাহায্য করে। আর অ্যান্টিবায়োটিক যেকোনো অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ফলে দেহ সুস্থসবল হয় এবং যৌনশক্তি বৃদ্ধি পায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে উপকারী
ছোলা টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রন প্রভাবকের কারণে ছোলা বেশ কার্যকরী। কেননা ছোলাতে থাকা ফাইবার এবং প্রোটিন খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা খুব দ্রুত বাড়তে বাধা দেয়, যা ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন বি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে এমনকি ছোলা লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। কারণ ছোলা তাদের রক্তে শর্করার বৃদ্ধি ঘটাতে বাঁধা দেয়।
আয়রনের ঘাটতি পূরণে
ছোলা আয়রনের একটি ভালো উৎস। ফলে এর অভার পূরণে ছোলা সাহায্য করে। কারণ ১৬৪ গ্রাম ছোলাতে দৈহিক মূল্যের ২৬% আয়রন থাকে। যা লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনের পাশাপাশি শারীরিক বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের বিকাশ, পেশীসহ দেহের বিভিন্ন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
দেহে পর্যাপ্ত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবে স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা তৈরির ক্ষমতা ব্যাহত হতে পারে। ফলে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে দুর্বলতা, ক্লান্তি এবং শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণগুলির প্রকাশ পায়। কিন্তু নিয়মিত ছোলা খেলে এমন সমস্যা হয় না। কারণ ছোলাতে ভিটামিন সি রয়েছে, যা শরীরের আয়রন শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায়তা করে।
ক্যান্সার রোধে
ক্যান্সার রোধে ছোলা কার্যকরী। কারণ কোরিয়ান গবেষকদের মতে, বেশি পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড খাবারের সাথে গ্রহণের মাধ্যমে নারীরা কোলন ক্যান্সার এবং রেক্টাল ক্যান্সার এর ঝুঁকি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেন।
হার্টের জন্য উপকারী
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্যমতে, বেশি পরিমাণে ফলিক অ্যাসিডযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে হাইপারটেনশন প্রবণতায় কমে যায়। কারণ ছোলায় বেশ ভাল পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড থাকে। যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া ছোলা বয়সসন্ধি পরবর্তীকালে মেয়েদের হার্ট ভাল রাখতেও সাহায্য করে।
কাঁচা ছোলা খাওয়ার অপকারিতা
হজমে সমস্যা: ছোলা খাওয়ার ফলে হজমের সমস্যা হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। এ সমস্যার ফলে অনেক সময় পেটে ব্যথার পাশাপাশি শারীরিক অস্বস্তির অনুভূতিও তীব্র হতে দেখা যায়। যা একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
পেটে গ্যাসের সমস্যা: অন্ত্র পুরোপুরি ছোলাকে শোষিত করতে পারে না। যে কারণে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের শিকার হতে পারেন আপনি। ছোলা খাওয়ার পর তাই অনেকেরই পেটে গ্যাসের সমস্যা দেখা দেয়।
দীর্ঘ সময় অস্বস্তিভাব: অলিগোস্যাকারাইড দিয়ে তৈরি ছোলা। এতে শর্করার পরিমাণও বেশি। তাই খাওয়ার পর অনেকেরই পেটে ফোলাভাব ও দীর্ঘ সময় ধরে অস্বস্তির সমস্যা দেখা দেয়।
আর্থাইটিসের সমস্যা বাড়ায়: ছোলায় পিউরিন উপাদান বেশি হওয়ায় তা শরীরে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। তাই আর্থাইটিসের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তি ছোলা খেলে তার আর্থাইটিসের সমস্যা আরও বাড়তে শুরু করে।
কিডনিতে পাথর তৈরি: প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে অক্সালেট বের করে দেয়া হয়। আর এ অক্সালেটই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ছোলায়। শরীরে বেশি পরিমাণে অক্সালেট কিডনিতে পাথর তৈরির কাজ করে।
হৃদরোগের সমস্যা: হৃদরোগে বিশেষ করে বিটা-ব্লকারের মতো নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সেবনকারী ব্যক্তিদের রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় রোগীর টিনজাত ছোলা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। কারণ টিনজাত ছোলায় প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে।
অ্যালার্জি: অনেকেই ছোলা খাওয়ার পর অ্যালার্জির সমস্যায় ভোগেন। কেউ আবার ছোলা খাওয়ার পর বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা এবং ত্বকে চুলকানি অনুভব করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া তীব্র হলে ছোলা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে কেননা অ্যালার্জির রোগীর ক্ষেত্রে কখনও কখনও ছোলা প্রাণঘাতীও হতে পারে।